নামাজ শুদ্ধ হওয়ার শর্ত

17437

 

প্রথমত: নামাজের ওয়াক্ত হওয়া

ফরয নামাজের সুনির্দিষ্ট সময় রয়েছে, যার আগে বা পরে নামাজ আদায় করলে তা শুদ্ধ হয় না। ইরশাদ হয়েছে :

(إِنَّ ٱلصَّلَوٰةَ كَانَتۡ عَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ كِتَٰبٗا مَّوۡقُوتٗا )

{নিশ্চয় নামাজ মুমিনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরয।}
[ সূরা আন-নিসা:১০৩]

নামাজের সময়

১. ফজরের নামাজের সময় :

সুবেহ সাদেক- র্অথাৎ পূর্বদিগন্তে যে শুভ্রতা দেখা যায়- থেকে সূর্যোদয় র্পযন্ত।

২. যোহরের সময় :

সূর্য ঢলে যাওয়ার পর থেকে প্রতিটি জিনিসের ছায়া তার দ্বিগুণ হওয়া পর্যন্ত।

৩. আসরের সময় :

যোহরের সময় শেষ হওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।

৪. মাগরিবের সময় :

সূর্য অস্ত যাওয়ার পর থেকে শফকে আহমার শেষ হওয়া পর্যন্ত। শফকে আহমার হলো সূর্যাস্ত যাওয়ার সময় পশ্চিমাকাশে যে লাল আভা থাকে তা।

৫. এশার সময়:

মাগরিবের সময় শেষ হওয়ার পর থেকে সুবেহ সাদেক উদয় হওয়া পর্যন্ত। ইমামদের কারো কারো কাছে মধ্য রাতে এশার সময় শেষ হয়ে যায়। তাদের দলিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস,«এশার নামাজের সময় মধ্যরাত পর্যন্ত।»(বর্ণনায় মুসলিম)

বর্তমানযুগে ক্যালেন্ডারের মাধ্যমে নামাজের সময় খুব সহজেই নির্ণয় করা সম্ভব।

কিছু ফায়েদা

- যে ব্যক্তি নামাজের ওয়াক্ত চলে যাওয়ার পূর্বে মাত্র এক রাকাত নামাজ পেল সে ওই নামাজ পেয়ে গেল। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, «যে ব্যক্তি নামাজের এক রাকাত পেল সে ওই নামাজ পেয়ে গেল।»(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

- যদি কারও ঘুমের কারণে নামাজ ছুটে গিয়ে থাকে অথবা মনে না থাকার কারণে নামাজ ছুটে গিয়ে থাকে, তবে জাগ্রত হওয়া ও মনে পড়ার সাথে সাথে তা আদায় করে নিতে হবে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, «যে ব্যক্তি কোনো নামাজ ভুলে গেল, স্মরণ হলে সে যেন তা আদায় করে নেয়।

«আর এটাই হলো তার কাফ্ফারা।»(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

দ্বিতীয়ত: অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জন

ছোট অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জন:

আর এটা সম্পন্ন হয় অজুর মাধ্যমে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, «যখন কারও অজু থাকে না, আল্লাহ তার নামাজ কবুল করেন না যতক্ষণ না সে অজু করে নেয়।» (বর্ণনায় বুখারী)

বড় অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জন:

আর এটা সম্পন্ন হয় গোসলের মাধ্যমে। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,

(وَإِن كُنتُمۡ جُنُبٗا فَٱطَّهَّرُواْۚ )

{আর যদি তোমরা জুনুবী হও তবে পবিত্রতা অর্জন করো)}[ সূরা আল মায়িদা:৬]

নামাজরত অবস্থায় যার অজু নেই বলে স্মরণ হলো, অথবা নামাজ পড়াবস্থায় অজু ছুটে গেল, এমতাবস্থায় নামাজ বাতিল বলে গণ্য হবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উচিত হবে, ছালাম দেয়া ব্যতীতই অজু করার জন্য মসজিদ থেকে বের হয়ে যাওয়া। কেননা নামাজ বিঘ্নিত হয়েছে এবং শেষ হয়নি। আর সালাম তো হলো নামাজ সম্পন্ন করার কাজ।

নামাজ ও নাজাসাত

যে ব্যক্তি না জেনে নাজাসাতসহ নামাজ পড়ল, অথবা নাজাসাতের কথা ভুলে গেল, তবে তার নামাজ শুদ্ধ হবে। হাদীসে এসেছে, «রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা নামাজ আদায় করে তাঁর জুতা খুলে ফেললেন। উপস্থিত লোকজনও তাদের জুতা খুলে ফেলল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করে বললেন, «তোমরা জুতা খুলে ফেললে কেন? উত্তরে তারা বললেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমরা আপনাকে খুলে ফেলতে দেখলাম, তাই খুলে ফেললাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, «জিব্রীল আমার কাছে এসেছেন এবং খবর দিয়েছেন যে এ-দুটোয় নাজাসাত রয়েছে। তাই যদি তোমাদের কেউ মসজিদে আসে তাহলে যেন সে তার জুতা উল্টিয়ে দেখে নেয়। যদি তাতে কোনো নাজাসাত দেখে সে যেন তা জমিনে মুছে নেয় এবং সে দুটোতেই নামাজ আদায় করে।»(বর্ণনায় আবু দাউদ )

নামাজরত অবস্থায় যে ব্যক্তি জানতে পারল যে তার গায়ে অথবা কাপড়ে নাজাসাত রয়েছে, তার উচিত হবে তা দূর করা এবং নামাজ চালিয়ে যাওয়া। ইতঃপূর্বে আদায়কৃত নামাজের অংশের উপর ভিত্তি করেই পরবর্তী অংশ আদায় করা। আর যদি নাজাসাত দূর করতে সক্ষম না হয়, তবে নামাজ বাতিল হয়ে যাবে।

তৃতীয়ত: কাপড়, শরীর ও জায়গা পাক হওয়া

১. কাপড় পাক;

আল্লাহ তাআলা বলেন,

(وَثِيَابَكَ فَطَهِّرۡ ٤ )

{আর তোমার পোশাক-পরিচ্ছদ পবিত্র কর।} [সূরা আল মুদ্দাসসির:৪]

২. শরীর পাক:

হাদীসের এসেছে, «রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা দুটি কবরের কাছ দিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, «এ-দুই কবরবাসীর আযাব হচ্ছে। এদেরকে বড় কোনো গুনাহর কারণে আযাব দেয়া হচ্ছে না। এই লোক তো পেশাব থেকে দূরত্ব বজায় রাখত না।»(বর্ণনায় আবু দাউদ)

৩. জায়গা পাক;

এর প্রমাণ মসজিদে পেশাবকারী ব্যক্তি-বিষয়ক হাদীস যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, «তাকে ছেড়ে দাও, আর তার পেশাবের ওপর এক বালতি পানি ঢেলে দাও।»(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

সমগ্র জমিনই মসজিদ

সমগ্র জমিনই মসজিদ। অতএব নাপাকিযুক্ত না থাকলে যেকোনো জায়গায় নামাজ আদায় করা শুদ্ধ। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, «আমার জন্য জমিনকে মসজিদ ও পবিত্র বানিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই আমার উম্মতের মধ্যে কোনো ব্যক্তি যখন নামাজের ওয়াক্ত পাবে সে যেন তা আদায় করে নেয়।»(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

ব্যতিক্রম হলো কেবল ওইসব জায়গা যার ব্যাপারে হাদীসে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, যেমন কবরস্থানে নামাজ। গোসলখানায় নামাজ। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, «সমগ্র জমিনই মসজিদ, তবে কবরস্থান ও গোসলখানা ব্যতীত।»(বর্ণনায় তিরমিযী)

উটের আস্তাবলে নামাজ পড়া বৈধ নয়। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«তোমরা উটের আস্তাবলে নামাজ পড়ো না।» উটের আস্তাবল হলো, উট যেখানে রাতযাপন করে ও আশ্রয় নেয়।»

(বর্ণনায় তিরমিযী)

চতুর্থত: সতর ঢাকা

পুরুষের সতর হলো নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত।

কাঁধ ঢাকা

পুরুষ এমন পোশাক পরবে যা দুই বাহু ও ঘার ঢেকে রাখবে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, «তোমাদের কেউ এমন এক কাপড়ে নামাজ পড়বে না যা তার দুই কাঁধকে খালি রাখে।
(বর্ণনায় তিরমিযী)

পঞ্চমত: কেবলামুখী হওয়া

কেবলা হলো পবিত্র কাবা।

আল্লাহ তাআলা বলেন :

(فَوَلِّ وَجۡهَكَ شَطۡرَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِۚ وَحَيۡثُ مَا كُنتُمۡ فَوَلُّواْ وُجُوهَكُمۡ شَطۡرَهُۥۗ)

{সুতরাং তোমার চেহারা মাসজিদুল হারামের দিকে ফিরাও এবং তোমরা যেখানেই থাক, তার দিকেই তোমাদের চেহারা ফিরাও।} [সূরা আল বাকারা:১৪৪]

কেবলার ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো নজরে রাখা আবশ্যক:

১- যে ব্যক্তি মসজিদুল হারামের ভিতরে নামাজ পড়বে তাকে সরাসরি কাবাঘরের দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হবে। আর যে ব্যক্তি কাবাঘর থেকে দূরে নামাজ পড়বে, কাবাঘর যে দিকে রয়েছে সেদিকে মুখ করে দাঁড়ালেই চলবে; কেননা এ অবস্থায় সরাসরি কাবাঘরের দিকে মুখ করে দাঁড়ানো হয়তো সম্ভব হবে না। এ জন্যেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন «পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝখানের সবটুকুই কেবলা»(বর্ণনায় তিরমিযী) {আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, উত্তর ও দক্ষিণের মাঝখানের সবটুকুই কেবলা}

কোনো যানবাহনে আরোহী ব্যক্তির কেবলা হলো যেদিকে সে গমন করছে তা। হাদীসে এসেছে, «রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাহনের ওপর নামাজ পড়তেন যেদিকে বাহন যেত সেদিকেই মুখ করে। তিনি বাহনের ওপর বেতরের নামাজও আদায় করতেন, তবে ফরয নামাজ পড়তেন না ।».
(বর্ণনায় আবু দাউদ)

কেবলার দিক অজ্ঞাত থাকলে কি করণীয়?

কেবলার দিক কোনটি তা যদি জানা না থাকে, সে যদি কোনো বিল্ডিং এর ভিতরে থাকে অথবা নিকটে কোনো মানুষ পায়, তবে তার উচিত হবে জিজ্ঞাসা করে জানার চেষ্টা করা। অথবা মসজিদের মেহরাব, কম্পাস, চাঁদ সূর্যের অবস্থান ইত্যাদির মাধ্যমে কিবলা নির্ণয়ের চেষ্টা করা। পরিশেষে ব্যর্থ হলে যান্নে গালেব তথা প্রাধান্যপ্রাপ্ত ধারণার ওপর নির্ভর করে নামাজ আদায় করে নেয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন:

(فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ مَا ٱسۡتَطَعۡتُمۡ) .

{অতএব তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করো ।}
[ সূরা আত-তাগাবুন:১৬]